রবিবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১৩

রহস্য ঘেরা উইন্ড কেভ


রাতবিরাতে শনশন শব্দ তুলে সচকিত করে দেয় চারপাশ। কালো পাহাড়ের ছোট গর্ত থেকে ভেসে আসে বিচিত্র সব আওয়াজ। কখনো মনে হয় গুহার ভেতর বসে মনের সুখে বাঁশি বাজাচ্ছে কেউ। অশরীরী আর দেও-দানোর কথা ভেবে পারতপক্ষে গুহাটার কাছে ঘেঁষে না ডাকোটার আদিবাসীরা। দূর থেকে পবিত্রজ্ঞানে পূজা করে। এভাবে বহুদিন মানুষের স্পর্শ না পেয়ে অনাবিষ্কৃত রয়ে গিয়েছিল আমেরিকার দক্ষিণ ডাকোটার উইন্ড কেভ।
বহুদিন পর ১৮৮১ সালে হরিণ শিকারে এসেছে দুই বিংহাম ভাই জেসি ও টম। তখনই চোখে পড়ে ১২ বাই ১০ ইঞ্চির ছোট গর্তটি। সামনে দাঁড়াতেই জেসির মাথার টুপি বাতাসের তোড়ে উড়ে গেল। মজা পেয়ে পরদিন সকালে বন্ধুবান্ধব ডেকে আনল তারা। এবার ঘটল বিপরীত। হঠা হ্যাঁচকা টানে ভেতরের ঘন অন্ধকারে সেঁধিয়ে গেল টুপিটা। বাতাসের এই অদ্ভুত খেল দেখিয়ে গুহাটি পরিচিত হয়েছে উইন্ড কেভতথা হাওয়া গুহা নামে। যদিও এতে ভেলকিবাজি কিছু নেই। রয়েছে ভেতর আর বাইরের বায়ুচাপের তারতম্যের জোরাল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।
সাহস করে অন্দরে ঢোকার চেষ্টা চালান চার্লি ক্রেরি নামের আরেক ব্যক্তি। কিছু দূর গিয়ে ইচ্ছে করে ফেলে আসেন পাকানো সুতার বান্ডিল। পরের অভিযাত্রী দল বান্ডিলটি খুঁজে পাওয়ায় মিলেছে তার দাবির সত্যতা। সত্যিই গুহার ভেতর হুট হাট ওঠানামা করে বাতাসের চাপ ও গতি। ১৮৯০ সালে সোনার খোঁজে হঠা দলবল নিয়ে উইন্ড কেভে হাজির হয় সাউথ ডাকোটা মাইনিং  কোম্পানি। কিন্তু খোঁড়াখুঁড়ি করে শুধু পরিশ্রমটাই হলো। কিছু না পেয়ে নতুন করে ভাবতে বসলেন তারা। এলাকার অধিবাসীদের অর্থের বিনিময়ে রোমাঞ্চের স্বাদ নেয়ার আহ্বান জানালেন। প্রথমদিকে মোমবাতি হাতে হামাগুঁড়ি দিয়ে সামান্য কিছু দূর দেখেই সন্তুষ্ট ছিল পর্যটকরা। তবে ব্যতিক্রম আলভিন ম্যাকডোনাল্ড নামের এক তরুণ। গুহার প্রতিটি কোণ চষে বেড়িয়েছেন বিচিত্র নেশায়। অভিজ্ঞতা টুকে রাখতেন নোটখাতায়। মোটামুটি একটা মানচিত্রও তৈরি করেছিলেন তিনি। আকস্মিক টাইফয়েডে মারা গেলে থেমে যায় তার অভিযাত্রা।
তবে আগের সেই ছোট গুহাটি আর ছোট নেই। এখন গুহার লম্বা রাস্তা ধরে এক মাইল এগুলে রহস্যঘেরা এক জগতের শুরু। সামনের পথ কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এক একটিতে রয়েছে শত শত গলি। এভাবে ছড়িয়ে আছে ছোট বড় তিন হাজার প্রকোষ্ঠ। মানচিত্রের হিসাব অনুযায়ী ১৩০ মাইল এলাকা জুড়ে গুহার অবস্থান। যার বিশাল অংশ এখনো দুর্ভেদ্য, অনাবিষ্কৃত। তবে স্বীকৃতি মিলেছে বিশ্বের চতুর্থ বৃহ গুহা হিসেবে।
বহুতল বাড়ির মতো উইন্ড কেভের কক্ষগুলো ধাপে ধাপে সাজানো। ওপর নিচে আটটি তলা আর পাশাপাশি ১২টি সমান্তরাল ফাটল। অদ্ভুত এই গোলকধাঁধায় রয়েছে অসংখ্য খনিজ। ছাদ ও দেয়াল থেকে বেরিয়ে আসা চোখা চুনাপাথর নানাদিক থেকে জাল তৈরি করেছে। দেখতে অনেকটা মৌচাকের মতো। অন্য একটি অংশে আছে সাদা স্ফটিক। যেগুলো দুই ইঞ্চি লম্বা সূঁচের মতো বেরিয়ে এসেছে গুহার গা থেকে। সারা বছর তাপমাত্রার তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না। যন্ত্রের কাঁটা সব সময় পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রির ঘরে থাকে। এমনকি ৫০০ ফুট যাওয়ার পরও তাপমাত্রার হেরফের হয় মাত্র এক ডিগ্রি। গবেষণার কাজে ভূতত্ত্বের শিক্ষার্থীদের প্রিয় জায়গা এটি। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান থিওডোর রুজভেল্ট ১৯০৩ সালের ৩ জানুয়ারি গুহাটির আশপাশের এলাকাকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করেন। কোনো গুহাকে বাঁচিয়ে রাখতে ওটাই ছিল প্রথম উদ্যোগ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন